প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে শাস্তির হুঁশিয়ারি

কলমানিতে সুদের সীমা লঙ্ঘন

টিবিটি ডেস্ক
টিবিটি রিপোর্ট
প্রকাশিত: ৩ এপ্রিল ২০২৪ ০১:০৭ এএম

কয়েক মাস আগে দেশের ব্যাংকগুলোতে তারল্য সংকট তৈরি হয় ভয়াবহ আকারে। মূলত আর্থিক অনিয়মের কারণেই এমনটা হয়েছিল। ফলে গ্রাহকরা টাকা উঠিয়ে নিতে শুরু করেন। এক মাসের মধ্যেই প্রায় ১ লাখ ৫০ হাজার কোটি টাকা তুলে নিয়েছিলেন গ্রাহক। যদিও পরে সেসব টাকা আবারও ব্যাংকে ফিরে আসতে শুরু করে। তবে এখনও তারল্য সংকট রয়েছে অনেক ব্যাংকে। তারল্য সংকটের ধকল সামলাতে তফসিলি ব্যাংক এবং ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান বা এনবিএফআই নিজেদের মধ্যে কলমানিতে (ওভার নাইট) ধার-দেনা করছে।

কলমানিতে সর্বোচ্চ সুদের সীমা ৯ দশমিক ৫০ শতাংশ। তবে অধিকাংশ ব্যাংকের বেঁধে দেওয়া সর্বোচ্চ সুদের সীমা মানার বালাই নেই। দেশের ৩৩টি বাণিজ্যিক ব্যাংক এবং ছয়টি আর্থিক প্রতিষ্ঠান সর্বোচ্চ ৯ দশমিক ৯০ শতাংশ পর্যন্ত সুদে ৫ হাজার ৮১১ কোটি টাকা লেনদেন করেছে। সুদহারের সর্বোচ্চ সীমা লঙ্ঘনের দায়ে প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে শাস্তির হুঁশিয়ারি দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সন্তোষজনক জবাব দিতে ব্যর্থ হলে প্রতিষ্ঠানগুলোকে জরিমানার মুখোমুখি হতে হবে। পাশাপাশি বাংলাদেশ ব্যাংকের তারল্য সুবিধাও বাতিল হতে পারে।

গত ২৭ মার্চ কলমানির সুদহার ১১ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ হিসাবে ৯ দশমিক ৫০ শতাংশে উঠেছে। ২০১২ সালের পর এটিই কলমানির সর্বোচ্চ। ওই বছর কলমানির সুদহার সর্বোচ্চ ১২ দশমিক ৮২ শতাংশে উঠেছিল।

দৈনন্দিন ও স্বল্প মেয়াদে টাকার চাহিদা মেটাতে এক ব্যাংক অন্য ব্যাংক থেকে ধার করে। যেসব ব্যাংকের কাছে অতিরিক্ত তারল্য থাকে, তারাই ধার দেয়। এ ধারের বিনিময়ে সুদ নেয় তারা। সুদের হার নির্ভর করে ধার নেওয়ার ওপর, এটা কত দিনের জন্য হচ্ছে ইত্যাদি। চাহিদা ও সরবরাহের ওপর নির্ভর করেও সুদহার ওঠানামা করে। কল মানি দেওয়া হয় মূলত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদারকিতেই।

চতুর্থ প্রজন্মের একটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, কলমানি হলো এক ব্যাংক থেকে অন্য ব্যাংকের টাকা ধার নেওয়া। দৈনন্দিন ও স্বল্প মেয়াদে টাকার চাহিদা মেটাতে এক ব্যাংক অন্য ব্যাংক থেকে ধার করে। যেসব ব্যাংকের কাছে অতিরিক্ত তারল্য থাকে, তারাই ধার দেয়। এ ধারের বিনিময়ে সুদ নেয় তারা। সুদের হার নির্ভর করে ধার নেওয়ার ওপর, এটা কত দিনের জন্য হচ্ছে ইত্যাদি। চাহিদা ও সরবরাহের ওপর নির্ভর করেও সুদহার ওঠানামা করে। কলমানি দেওয়া হয় মূলত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদারকিতেই।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একটি সূত্র বলছে, ৩৩টি ব্যাংক বেঁধে দেওয়া সর্বোচ্চ ৯ টাকা ৫০ পয়সা সুদের সীমা লঙ্ঘন করেছে। সুদহারের সীমা না মেনেই গত ২৫ জানুয়ারি পর্যন্ত এসব ব্যাংক ৩ হাজার ১০৫ কোটি ধার করেছে। একই সময়ে অভিযুক্ত ব্যাংকগুলো ২ হাজার ৬১০ কোটি অন্য ব্যাংকে ধার দিয়েছে। একইভাবে ৬টি ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান সর্বোচ্চ সুদের সীমা ভেঙে ৯ দশমিক ৯০ শতাংশ হারে ৯৫ কোটি ৩৫ লাখ টাকা ধার করেছে। এ ধরনের লেনদেন ব্যাংকিং নীতিমালার পরিপন্থি হিসেবে দেখছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

তথ্য বলছে, সরকারি মালিকানাধীন জনতা ব্যাংক ৯ টাকা ৭৫ পয়সা দরে কলমার্কেটে অন্য ব্যাংক থেকে ৪৮১ কোটি টাকা ধার করেছে। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকও একই রেটে ৯৫ কোটি টাকা ধার দিয়েছে। বিশেষায়িত বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক ৯ টাকা ৯০ পয়সা দরে ৪৫৯ কোটি টাকা ধার দিয়েছে। বিদেশি খাতের স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়া ৯ টাকা ৬০ পয়সা রেটে ধার দিয়েছে ৩০৪ কোটি টাকা, ব্যাংক অব সিলং ধার দিয়েছে ৯ টাকা ৭৫ পয়সা দরে ১১৬ কোটি টাকা এবং ব্যাংক আল ফালাহ ১৭৬ কোটি টাকা কলমানিতে ধার দিয়েছে।

দেশের ৩৩টি বাণিজ্যিক ব্যাংক এবং ছয়টি আর্থিক প্রতিষ্ঠান সর্বোচ্চ ৯ দশমিক ৯০ শতাংশ পর্যন্ত সুদে ৫ হাজার ৮১১ কোটি টাকা লেনদেন করেছে। সুদহারের সর্বোচ্চ সীমা লঙ্ঘনের দায়ে প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে শাস্তির হুঁশিয়ারি দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সন্তোষজনক জবাব দিতে ব্যর্থ হলে প্রতিষ্ঠানগুলোকে জরিমানার মুখোমুখি হতে হবে। পাশাপাশি বাংলাদেশ ব্যাংকের তারল্য সুবিধাও বাতিল হতে পারে।

বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মধ্যে সিটি ব্যাংক ৯ টাকা ৭৫ পয়সা দরে ৩০০ কোটি টাকা ধার দিয়েছে। এবি ব্যাংক ৯ টাকা ৮০ পয়সা দরে ধার করেছে ৬০ কোটি টাকা। মিডল্যান্ড ব্যাংক ২৩৫ কোটি টাকা ধার করেছে ৯ টাকা ৮০ পয়সা সুদহারে। আইএফআইসি ব্যাংক ৯ টাকা ৯০ পয়সা সুদহারে ২০৯ কোটি এবং সিটিজেন ব্যাংক ৯ টাকা ৭৫ পয়সা দরে ১৮ কোটি টাকা অন্য ব্যাংকে ধার দিয়েছে। 

ইউসিবি ৯ টাকা ৭৫ পয়সা সুদহারে ধার করেছে ২৯৭ কোটি টাকা এবং একই সময়ে ব্যাংকটি ৯ টাকা ৮০ পয়সা সুদহারে অন্য ব্যাংকে ধার দিয়েছে ২৮০ কোটি টাকা। এনসিসি ব্যাংক ৯ টাকা ৮০ পয়সা সুদে ধার করেছে ১০৪ কোটি, একই সুদহারে এনআরবি ধার করেছে ৭৫ কোটি টাকা।

ইস্টার্ন ব্যাংক ৯ টাকা ৬০ পয়সা দরে ধার করেছে ১২৩ কোটি টাকা, এসবিএসি ব্যাংক একই দরে ১৪৪ কোটি টাকা, ঢাকা ব্যাংক ৯ টাকা ৮০ পয়সা সুদহারে ৩৬৪ কোটি টাকা, প্রিমিয়ার ব্যাংক ৯ টাকা ৬০ পয়সা সুদহারে ৪৫ কোটি টাকা ধার করেছে। এনআরবিসি ব্যাংক ৯ টাকা ৭৫পয়সা সুদহারে ধার করেছে ২৫ কোটি টাকা। মধুমতি ব্যাংক ৯ টাকা ৭৫ পয়সা সুদহারে ধার করেছে ১১৫ টাকা; একইসময়ে একই রেটে ৬১ কোটি টাকা ধার দিয়েছে ব্যাংকটি।

বেসরকারি খাতের সাউথইস্ট ব্যাংক ৯ টাকা ৭৫ পয়সা সুদহারে অন্য প্রতিষ্ঠানকে ধার দিয়েছে ৬১ কোটি টাকা।

ব্যাংক এশিয়া ৯ টাকা ৬০ পয়সা সুদহারে ৮১ কোটি টাকা ধার করলেও একই রেটে ৪০ কোটি টাকা অন্য প্রতিষ্ঠানকে ধার দিয়েছে। সীমান্ত ব্যাংক ৯ টাকা ৯০ পয়সা সুদহারে ৬৩ কোটি টাকা ধার দিয়েছে, উত্তরা ব্যাংক ৯ টাকা ৭৫ পয়সা সুদহারে ধার দিয়েছে ৪৬৪ কোটি টাকা। আলোচিত সময় পর্যন্ত ওয়ান ব্যাংক ৯ টাকা ৬০ পয়সা সুদহারে ধার করেছে ১০ কোটি টাকা, পূবালী ব্যাংক একই সুদহারে ২৫৫ কোটি টাকা, যমুনা ব্যাংক ৯ টাকা ৯০ পয়সা সুদহারে ৪৬৬ কোটি টাকা, মেঘনা ব্যাংক ৯ টাকা ৮০ পয়সা সুদহারে ৮৫ কোটি টাকা এবং কমিউনিটি ব্যাংক ৯ টাকা ৯০ পয়সা সুদহারে ১০৪ কোটি টাকা ধার করেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. মেজবাউল হক এ বিষয়ে জানান, তারল্য ব্যবস্থা ব্যাংকের নিজস্ব বিষয়। আইন বা নীতিমালা মানতে বাধ্য সব ব্যাংক। কলমানি থেকে ইচ্ছামতো রেটে লেনদেন করলে তো রেট নির্ধারণের দরকার ছিল না। এটা হলে বাজারে অস্থিরতা দেখা দিতে পারে। তবে কোনো ব্যাংককে এ বিষয়ে শাস্তির আওতায় আনার আগে তদন্ত করবে বাংলাদেশ ব্যাংক। নিয়ম লঙ্ঘনের দায় প্রমাণিত হলে আইন অনুযায়ী শাস্তি পাবে।